বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। গবেষক, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ এতে যুক্ত হয়েছেন। এক্ষেত্রে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যার ভিত্তিতে দাবি করা হচ্ছে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। যদিও এ বিষয়ে ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো, কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব আর কোটিপতির সংখ্যা কখনই এক নয়।
কোটিপতির সংখ্যা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘শিডিউলড ব্যাংকস স্ট্যাটিস্টিকস’ নামের একটি প্রকাশনার তথ্য উদ্ধৃত করা হয়। ওই প্রকাশনার জুন সংখ্যার তথ্যমতে, দেশে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা আছে এমন ব্যাংক হিসাব ১ লাখ ৮ হাজার ৪৫৭টি। এসব ব্যাংক হিসাবে জমা আছে ৬ লাখ ৮০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার আমানত। কোটি টাকার বেশি স্থিতি থাকা এসব ব্যাংক হিসাবকেই কোটিপতি বলে উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকে থাকা কোটি টাকার হিসাবগুলোর অন্তত ৯০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার ও পরিমাণ বাড়ায় কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব বাড়ছে।
কোটি টাকার স্থিতি থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিলেও সে হিসাবগুলোর মধ্যে ব্যক্তির সংখ্যা কত, সে পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও নেই। দেশের অন্তত ১০টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে খোঁজ নিয়েছে দেখা যাচ্ছে, এ ব্যাংকগুলোর কোটি টাকার বেশি হিসাবের মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ ব্যক্তির। বাকি হিসাবগুলো সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশী খাতের প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে করপোরেট প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানও।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ মনে করেন, দেশে কোটিপতির সংখ্যা বলতে পারার একমাত্র প্রতিষ্ঠান হলো এনবিআর। ব্যাংক হিসাবের ভিত্তিতে কোটিপতির সংখ্যা বলার সুযোগ নেই। তবে এনবিআর কখনো কোটিপতির সংখ্যা বের করার উদ্যোগ নেয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুনের শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় জমাকৃত আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। মোট ১২ কোটি ৯৫ লাখ ১৪ হাজার ৫১৩টি ব্যাংক হিসাবে এ আমানত জমা হয়েছে। দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ সরকারি। বাকি ৮২ দশমিক ৬৯ শতাংশই বেসরকারি খাতের। সরকারি খাতের ২ লাখ ৭২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকার আমানতের পুরোটাই প্রাতিষ্ঠানিক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের মোট ব্যাংক আমানতের প্রায় ১৯ শতাংশ জমা রয়েছে চলতি ও বিশেষ নোটিসের হিসাবে। এ দুই শ্রেণীর হিসাবের শতভাগই প্রাতিষ্ঠানিক। সবচেয়ে বেশি ৪৩ শতাংশ অর্থ জমা আছে ব্যাংকগুলোর মেয়াদি আমানত হিসাবে। ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রাখে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ২৩ শতাংশ আমানত গ্রাহকদের সঞ্চয়ী হিসাবে জমা রয়েছে। এ শ্রেণীর ব্যাংক হিসাবের বেশির ভাগই ব্যক্তিশ্রেণীর।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটিতে জমা ছিল গ্রাহকদের ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকার আমানত। এ আমানতের বড় অংশই ব্যক্তিশ্রেণীর। তবে ব্যক্তিশ্রেণীর গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত আমানতের পরিমাণ কম। বড় অংকের আমানতের সিংহভাগই প্রাতিষ্ঠানিক।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা জানান, কোটিপতি শব্দটি ব্যক্তিবাচক। কোনো ব্যক্তির কাছে কোটি টাকার সম্পদ থাকলে তাকে কোটিপতি বলা যায়। কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকার আমানত থাকলে সেটিকে কোটিপতি বলার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মোট হিসাব সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি হলেও এর বড় অংশই নিষ্ক্রিয়। ৯ কোটি ৫১ লাখ ৩৯ হাজার ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত আমানতের স্থিতি ৫ হাজার টাকারও কম। কোটি টাকার বেশি আমানত আছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ১ লাখ ৮ হাজার ৪৫৭। মোট ব্যাংক হিসাবের তুলনায় এ সংখ্যা ১ শতাংশের কম হলেও এসব ব্যাংক হিসাবে ৬ লাখ ৮০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার আমানত জমা রয়েছে। অর্থাৎ দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ৪৩ দশমিক ২২ শতাংশই জমা আছে ১ শতাংশেরও কম ব্যাংক হিসাবে।
৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত জমা আছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ১ হাজার ৮০৫। এসব ব্যাংক হিসাবে জমা আছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮১২ কোটি টাকার আমানত। বড় অংকের অর্থ জমা থাকা এসব ব্যাংক হিসাবের শতভাগই প্রাতিষ্ঠানিক বলে জানা গিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ৫ কোটি টাকার বেশি জমা আছে এমন ৯৮ শতাংশ ব্যাংক হিসাবই প্রাতিষ্ঠানিক। ব্যক্তিশ্রেণীর ব্যাংক হিসাবগুতে সর্বোচ্চ ১ থেকে ৫ কোটি টাকার আমানত থাকতে পারে। ১ থেকে ৫ কোটি টাকা আমানত থাকা ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ৮৫ হাজার ৮৪১। এসব ব্যাংক হিসাবেরও ৭০-৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের। ব্যক্তিশ্রেণীর ব্যাংক হিসাবে এ পরিমাণ অর্থ জমা থাকে না।
–
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ধনীক শ্রেণী কখনই এক ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকার আমানত জমা রাখে না। কোটিপতিরা ৫-৭ লাখ টাকা করে শত শত ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা করেন। এমপি পাপুলও এভাবে শত শত ব্যাংক হিসাব খুলে মেয়াদি আমানত রেখেছিলেন। ফলে শুধু ব্যাংক হিসাবে থাকা আমানত দিয়ে কোনো ব্যক্তির সম্পদের পরিমাপ করা যায় না।
কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবকে আমলে নিয়ে দেশের কোটিপতির সংখ্যা গণনা করা হলে সেটি ভুল বার্তা দেবে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের ব্যাংকে কোটি টাকার বেশির ভাগ হিসাবই প্রাতিষ্ঠানিক। প্রতিনিয়ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাবগুলোয় অর্থ লেনদেন হয়। আজকে যে ব্যাংক হিসাবে শতকোটি টাকা আছে, কালকে সে হিসাবে কোনো অর্থ নাও থাকতে পারে। ব্যক্তিশ্রেণীর ব্যাংক হিসাবে সাধারণত বড় অংকের অর্থ জমা থাকে না।